চার পাশে সাগর উত্তাল মাঝ খানে দ্বীপ, ঘন বন । নাই বনে শিয়াল বাঘ। কুকুর বাঘের দায়িত্ব পালন করে বীর দর্পে । আস্ত হরিণের তাজা কংকাল পড়ে থাকে এখানে ওখানে। খাবলে খাবলে মাংস খাওয়া কংকাল। রক্ত লেগে আছে এখনো কেওড়া গাছের গোঁড়ায়।
জঙ্গল থেকে এক পা দু পা করে এগিয়ে আসে বড় বড় হরিণের পাল। পিছু পিছু হেটে চলে শিশু বাচ্চারা। মা মা দেখ দেখ ঐ যে বাতাসে নুয়ে পড়েছে কেওড়া গাছের ডাল। পাতা গুলো কেমন করে এদিক ওদিক দোল খাচ্ছে। অন্য পাতাদের সাথে খেলা করছে। মা আমি এখন অনেক পাতা খাব, দেখ মা আমার পেট পরে গেছে। ক্ষুধায় জ্বালা করছে। মা মা আমার ভয় করছে। কোন ভয় নেই বাছা। এসো আমার সাথে। তোমার মুখে তুলে দিব কচি কচি পাতা। মা আর বাচ্চায় কথা বলে এগিয়ে যায় ক্ষুধার তাড়নায় পাতার লোভে। মা জানে ভয়ের কারণ, ভয় আছে জীবনের। তবু বাচ্চাকে সান্ত্বনা দেয়। কোন ভয় নেই দেখ আমরা সবাই আছি। কোন শত্রু নেই পাশে। এক পাল হারিণ মুহূর্তেই সাবাড় করে দেয় একের পর এক গাছের সবুজ সবুজ পাতা। আজ বাচ্চা গুলো পেট পুরে খেতে পেরেছে।
প্রায় এক মাস বৃষ্টি হয়নি। খড়ায় পুড়ে যাচ্ছে ঘাস গুলো। ঘাস খাওয়ার কোন উপায় নেই। তাই পাতার উপর নির্ভর করতে হয়। বনের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে চলে। গাছের সবুজ পাতা খেয়ে জীবন বাঁচায়। কিন্তু খাওয়ার পানির কোন ব্যবস্থা নেই। সাগরের বুকে বাস করেও পানির অভাবে মরার উপক্রম। বড়রা সহ্য করতে পারলেও ছোটরা কান্না কাটি করছে। মা বুক জ্বলে যাচ্ছে পানি পানি। কোথাও পানি নেই। দল বেঁধে এ পাশে ও পাশে ঘুরেও কোন নালায় পানির সন্ধান পায় না। হঠাত করেই শুরু হল সামুদ্রিক ঝড় সাথে প্রচণ্ড বৃষ্টি। বাচ্চারা বড়রা সবাই কয়েক দিন পর প্রথম পানি পেয়ে খুব আনন্দ করে। এ সুখ বেশী ক্ষণ সইল না। আস্তে আস্তে ঝড়ের গতি বাড়তে লাগল। সেই সাথে বৃষ্টিও। সারা রাত বৃষ্টিতে ভিজে জুবু থুবু। ঠান্ডা জ্বরে ভুগছে ছোটরা। বাচ্চাদের সমস্যাই বেশী। তারা কোন কিছুই একটু বেশী হলে সইতে পারে না। অতি বৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খড়া, খাদ্যের অভাব সব কিছুতেই তারা আগে দুর্বল হয়। তার পর নেয় চির বিদাই। সারা রাতের ঝড় বৃষ্টিতে এই পালের অনেক বাচ্চাই মরে গেল। চোখের সামনে বাচ্চাদের মরা দেখে কেউ স্থির থাকতে পারল না। বৃষ্টির ফোটায় চোখের পানি দেখা যায় না। বৃষ্টির পানি চোখের পানি এক হয়ে মিশে যাচ্ছে সাগরে। হৃদয়ের কান্না দেখা যায় না। কয়েকটা হরিণ মাত্র বেঁচে রইল।
টানা ঝড় বৃষ্টির পর সূর্য উঠেছে। বড়রা শরীর শুখাতে ব্যস্ত। ছোটরা শরীর নিয়ে নড়তে পারছে না। গায়ে একটু রোধ লাগতেই কেমন চঞ্চল হয়ে উঠে। তার পর শুরু করে আবার দৌড়া দৌড়ি। মার কাছ থেকে একটু দূরে যায় আবার ফিরে আসে। তার পর আবার, তার পর আবার। মা দেখে আর হেসে বলে_ বেশী দূরে যেওনা বাছা। আমার কাছেই থেক। না মা আমি দৌড় শিখব, অনেক দৌড়। কোন শত্রু আমাকে ধরতে পারবে না। _ বাচ্চা আমার _ বলে মা ঘাসে মুখ দেয়। খেতে থাকে নিজের জন্য। বাচ্চার জন্য। নিজে না খেলে বাচ্চা দুধ পাবে না। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে মাথা উঁচু করে তাকিয়ে দেখে বাচ্চাকে_ নাহ বেশ খেলছে। তার পর আবার ডেকে বলে _ বেশী দূরে যেও না। ভয় পেলে আমার কাছে এসো। বাচ্চা কোন কথা কানে নেয় না। খেলতে থাকে কয়েকটি বাচ্চার সাথে। খেলতে খেলতে বনের মধ্যে শিকারির পাতা ফাঁদে আটকে যায় দুটি বাচ্চার পা। একটি দৌড়ে পালালেও ঐদুটি আর ফিরতে পারে নি। শিকারিরা ধরে ফেলে। মা হরিণটি কাঁদতে কাঁদতে এদিক ও দিক খুঁজে অবশেষে ফিরে যায় গভীর জঙ্গলে।
প্রাকৃতিক নিয়মে সবুজ বনে মা হরিণটি আবারও মা হতে শুরু করেছে। মাঝে মাঝে তার ভয় হয়, বাচ্চা গুলো বড় হবার আগেই শেষ হয়ে যায়। কয়েক বছরে পালের একটি বাচ্চাও বেচে নেই। সংখ্যায় আর বাড়তে পারেনি। বরং কমেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে অর্ধেকের কম বাচ্চা মারা যায়। আর বেশীর ভাগ মানুষের হাতে। তার মধ্যে থেকে দুএকটি বাচ্চা কোন ভাবে বড় হয় বলেই এখনো টিকে আছে হরিণের জাত। তা না হলে বিলুপ্তির খাতায় নাম উঠে যেত হরিণেরও।
মা হরিণটি গত কাল শেষ রাতে তিনটি ফুটফুটে সুন্দর বাচ্চা প্রসব করেছে। সবুজ বনে সুখের বন্যা এসেছে হরিণ গুলির মাঝে। বাচ্চা গুলো সকালের মধ্যেই কেমন দৌড় দৌড় খেলছে। যতই দৌড়া দৌড়ি করছে মায়ের ততই ভয় বাড়ছে। তারাতো আর জানে না প্রকৃতির কি নিয়ম। তারাতো আর মানুষ চিনে না। তারা এখনো ভাই বোন আর মা ছাড়া কিছুই বুঝে না। পালের সব হরিণই খুশি হয়। বড়দের মাঝে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় খাদ্যের সন্ধানে। কান দুটি খাড়া করে রাখে সব বড় হরিণ গুলো। কখন বিপদ আসে। হঠাত করেই জঙ্গলের কয়েকটি গাছ বাসাসে ঝড় ঝড় শব্দ করে নড়ে উঠে। বিপদ বিপদ বলে সবাই পালাতে থাকে। বাচ্চা তিনটি কিছুই বুঝে না, ভাবে সবাই খেলছে। তার পর দৌড় থামলে মায়ের কাছে বিপদ কি তা জানতে চায়। মা তাকে বুঝায় এমন হলে দৌড় দিতে হয়। নিরাপদ স্থানে যেতে হয়। আমাদের জীবনের ভয় সব সময়। তাই সতর্ক থাকতে হয়।
কয়েকটি কুকুর দূর থেকে দেখে একটি বাচ্চা হরিণ খেলা করছে। পাশে আরো কয়েকটি বাচ্চা। বড়রা একুটু দূরেই ঘাস খাচ্ছে বনের বাহিরে ছোট্ট একটি মাঠে। কুকুরের স্বভাব বসতই ঘেউ ঘেউ শুরু করে। এক পর্যায়ে দৌড়ে পাঠিয়ে দেয় বনের ভিতর। খাদ্যের অভাবে হরিণের পালকে ছুটা ছুটি করতে হয় বনের এ পাশ থেকে ঐ পাশে। চার পাশে সাগর তাই এখান থেকে যাওয়ার উপায় নেই। কুকুর গুলোও খুধায় কাতর হয়। এক সময় কয়েকটি কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ডুকে পরে বনের ভিতর। তাদের কোন খাদ্য নেই। বড় হরিণকে কাবু করতে অনকে ঝামেলা। তাই ছোট ছোট বাচ্চা গুলোকে ধরে ধরে খওয়া শুরু করে। এর আগে হরিণের মাংসের স্বাদ পায়নি। এখন সুস্বাদু মাংসের স্বাদ পেয়ে বন থেকে সরতেই চায় না। কুকুরের বাচ্চা মরে না। তাই দুতিন বছরেই কয়েকটি থেকে এক পাল হয়ে যায়। তারা সবাই হরিণের মাংস ভোজি হয়ে গেছে। অন্য কোন খাদ্যের খোঁজও করে না। বন ছেড়ে বাহিরেরও যায় না। বেওয়ারিশ কুকুর গুলো স্থায়ী হয়ে গেছে বনে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ কয়েক বছরে হয়তো একবার নির্মম হয়ে উঠে। কিন্তু কুকুরের পাল প্রতি দিনের বিপদে পরিণত হয়। দিনে এমনকি রাতেও হরিণ ধরে ধরে খায়। এখন বাচ্চা টিকিয়ে রাখা বড় কঠিন হয়ে পড়েছে। তার পর বড় বড় হরিণ গুলো মানুষ ধরে নিয়ে যায়। ফাঁদ পেতে, গুলিকরে, জাল দিয়ে ধরে। মাঝে মাঝে কয়েকটি কুকুর এক জোট হয়ে বড় হরিণও ধরে ফেলে। মহিলা হরিণের চাইতে পরুষ হরিণ ধরতে কুকুরের জন্য সহজ। এখানে সেখানে পরে থাকে আস্ত হরিণের কঙ্কাল। কোনটা অর্ধ খাওয়া, কোনটা একটু, আবার কোনটা হাড় ছাড়া কিছুই নেই। কুকুরে খেলে হাড়গোড় দেখা যায়। মানুষে শত শত হরিণ সাবাড় করছে তার কোন প্রমাণ বনে থাকে না। হরিণের হাড় চামড়া কিছুই থাকে না। কুকুর খাদ্য নিবারণের জন্য হরিণ খায়। আর মানুষ টাকার জন্য। মানুষের অনেক ধরনের খাদ্যের যোগান আছে। হরিণ শিকার না করলেও মানুষের কোন ক্ষতি হয় না। অথচ মানুষের হাতেই হরিণ কমে সব চাইতে বেশী। প্রাকৃতিক নিয়মে বাঁচার অধিকার তারা পায় না। মানুষ প্রকৃতির নিয়ম বদলায়। নিজ হাতে গড়ে নিয়ম ভাঙ্গার অনিয়ম।
পুরো বন জুড়েই রয়েছে অনেক হরিণের পাল। ঠিক মতো তারা বাচ্চাও প্রসব করে। ঘুরে বেড়ায় সারা জঙ্গল। তিন ভাই বোন এক সাথে খেলার সময় একটিকে ধরে ফেলে কুকুরের পাল। মা মা আমাকে বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও। মা দূর থেকে অসহায় হয়ে তাকিয়ে দেখে। কিছুই করার নেই তার। কুকুর গুলো এখন বেপরোয়া হয়ে গেছে। প্রতি সপ্তাহে একটি দুটি করে হরিণ খেয়ে ফেলে। আজ সকালে আরো একটি বাচ্চা খায়। এখন মাত্র একটি বাচ্চা বেঁচে আছে। মা তাই খুব চিন্তায় পরে যায়। এখন খাদ্য খুঁজতেও বিপদ। কুকুর গুলো জানে কোথায় কোথায় তারা খেতে যায়, কোথায় তারা পানি পান করতে যায়। অলস সময় সেখানেই থাকে। ক্ষুধা লাগলে ওত পাতে সিংহের মত। মানুষ সেরকম নয়। সমস্ত জঙ্গল মানুষের হাতের মুঠোয়।
সবুজ বন সবুজ পাতা সবুজ হরিণের মন। বাঁচতে পারে না ভালো ভাবে ভয়ে থাকে সারাক্ষণ। চার পাশে নোনাজল সাগর উত্তাল সবুজ বনে দাগ ছোপ ছোপ রক্ত লাল।
নাই বনে শিয়াল বাঘ। যে বনে শিয়ালও নেই সেখানে কুকুরই বাঘ হয়ে উঠে। বাঘের দায়িত্ব পালন করে। হিংস্রতায় তুলনা করলে এই নিরীহ প্রাণীর জন্য কুকুরই বাঘ। যদিও এই হরিণ গুলো কখনো বাঘ দেখেনি। বাঘ একবার খেলে আবার ক্ষুধা না লাগলে শিকার করে না। মানুষের যতই পেট ভরা থাক, যত টাকা পয়সাই থাক। মনের ক্ষুধা মিটে না। মানুষ বাঘের চাইতেও হিংস্র। মা হরিণটি গভীর বনে ঘুরতে ঘুরতে এক স্থানে গিয়ে দেখে লাল রক্তে ঘাস গুলো ভিজে আছে। কেওড়া গাছে লেগে আছে ছোপছোপ রক্ত। সবুজ বনে লাল রক্তের বন্যা। বাচ্চাটি অসহায় মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে_ মা কুকুর আমাদের ধরে ধরে খায়, মানুষও আমাদের ধরে খায়, বিক্রি করে। কুকুর আর মানুষের মধ্যে পার্থক্য কোথায় । মা হরিণ চোখের কোনে জল, আর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তাকিয়ে থাকে অসহায় বাচ্চার মুখের দিকে।
আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
তানি হক
সবুজ বন সবুজ পাতা সবুজ হরিণের মন।
বাঁচতে পারে না ভালো ভাবে ভয়ে থাকে সারাক্ষণ।
চার পাশে নোনাজল সাগর উত্তাল
সবুজ বনে দাগ ছোপ ছোপ রক্ত লাল।......অনেক অনেক ভালো লাগলো বন্ধুর গল্পটি ..আলাদা ভাবে মনে রাখার মত ...শুভকামনা আর ধন্যবাদ জানাই...
প্রশান্ত কুমার বিশ্বাস
কুকুর আর মানুষের মধ্যে পার্থক্য কোথায় । মা হরিণ চোখের কোনে জল, আর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তাকিয়ে থাকে অসহায় বাচ্চার মুখের দিকে। ---------- অসাধারণ! এদেশের অগুণতি মানুষ তার সন্তানের অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না, শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে- উঁচুতলার মানুষের ভয়ে। অনেক অনেক ধন্যবাদ।
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
বিজ্ঞপ্তি
“ডিসেম্বর ২০২৪” সংখ্যার জন্য গল্প/কবিতা প্রদানের সময় শেষ। আপনাদের পাঠানো গল্প/কবিতা গুলো রিভিউ হচ্ছে। ১ ডিসেম্বর, ২০২৪ থেকে গল্প/কবিতা গুলো ভোটের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং আগামি সংখ্যার বিষয় জানিয়ে দেয়া হবে।